বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রা মার্কিন ডলার। ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে ডলার তার প্রভাবশালী রিজার্ভ স্ট্যাটাস অর্জন করে। তখন থেকেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ ও লেনদেনে একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রেখেছে মার্কিন ডলার।
শক্তিশালী মুদ্রা হওয়ায় বিশ্বের অনেক দেশই এটিকে ‘রিজার্ভ মুদ্রা’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। তবে এখন পরিস্থিতির বদল হচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ক্ষুণ্ন করতে বিকল্প মুদ্রা তৈরির চেষ্টা দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে চীন ও রাশিয়া কয়েক বছর ধরেই কাজ করে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোও রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলারের আধিপত্য রুখতে এটি একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রূপ নিতে পারে। এরই মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে ডলারের বিকল্প হিসেবে রুবল দিয়ে লেনদেন করছে রাশিয়া। একইসঙ্গে চীনের ইউয়ান দিয়েও সংঘটিত হচ্ছে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক লেনদেন। এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতও আমিরাতের দিরহাম, চীনের ইউয়ান, হকংয়ের ডলার দিয়ে রাশিয়া থেকে জ্বালানী কিনছে। এরফলে যুক্তরাষ্ট্র যতোটা ভেবেছিল ততোটা প্রভাব পড়েনি রাশিয়ার ওপর। বরং নিষেধাজ্ঞায় উল্টো ফুলে ফেপে উঠেছে রুশ মুদ্রার মান। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কমে যাওয়া ঠেকানোর পাশাপাশি ডলারের সংকট সামাল দিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ডলারের বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের কথা ভাবছে বাংলাদেশ সরকার। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, এতে বছরে ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয়ের সম্ভাবনা আছে।
এরআগে গত এপ্রিলে ইসরায়েল প্রথমবারের মতো দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে চীনা মুদ্রা ‘রেনমিনবি’ যোগ করেছে। দেশটি নতুন কৌশল হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান ডলার, কানাডিয়ান ডলার ও জাপানিজ ইয়েনের রিজার্ভ বাড়িয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ডেভিড লেডলার বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলারের স্ট্যাটাস তথা মর্যাদা থেকে একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সুবিধা পায়। যখন অন্য দেশগুলো তাদের ডলারের হোল্ডিং বাড়ায়, তখন লেনদেনের স্ট্রিংয়ে জড়িত চূড়ান্ত পণ্য হলো যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ফেড প্রিন্ট’ কাগজের বিনিময়ে আসল পণ্য ও পরিষেবা পায়। ’
মার্কিন ডলার এখনো প্রভাবশালী হলেও এ ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে, যা এ মুদ্রার আধিপত্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে।
বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক রিজার্ভের ক্ষেত্রে শক্তিশালী চারটি মুদ্রা প্রাধান্য পেয়ে আসছে। এসব মুদ্রা হচ্ছে মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, জাপানি ইয়েন ও ইউরো। ১৯৯৯ সালে বৈদেশিক রিজার্ভের ৯৮ শতাংশ এ মুদ্রাগুলো থাকলেও ২০২১ সালে তা ৯২ শতাংশে নেমে এসেছে। এতে নতুন মুদ্রা হিসেবে যোগ দিয়েছে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার ডলার।
আইএমএফের ২০২২ সালের প্রথম প্রান্তিক হিসাব অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশের কাছে প্রয়ে ২২৫.৪৮ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার রয়েছে। এর পাশাপাশি বৈদেশিক রিজার্ভ হিসেবে বিশ্বের দেশগুলোর কাছে ২৮৭ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার রয়েছে।
এদিকে রাশিয়া ও চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্রিকস দেশগুলো গত ২৩ জুন চীনের বেইজিংয়ে তাদের ১৪তম শীর্ষ সম্মেলনে নতুন একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা প্রচলনের পরিকল্পনার কথা জানায়। তাতে বলা হয়, পাঁচটি প্রধান উদীয়মান অর্থনীতির নেতারা আন্তর্জাতিক রিজার্ভ মুদ্রা তৈরির জন্য একমত হয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্রিকস মুদ্রা মার্কিন ডলার এবং আইএমএফের স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর) মুদ্রার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য শক্তিশালী হবে। ব্রিকস সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেন, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা একটি ‘নতুন বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা’ চালু করার পরিকল্পনা করেছে। এ ছাড়া তুরস্ক, মিসর ও সৌদি আরব ব্রিকসে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছে।
বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন যে ব্রিকসের রিজার্ভ কারেন্সি তৈরির পদক্ষেপ মার্কিন ডলার এবং আইএমএফের এসডিআরগুলোকে দুর্বল করে দেবে। ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে রাশিয়ান ফেডারেশন এবং ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ৩৮ শতাংশ বেড়ে ৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত নমিন্যাল জিডিপি সাড়ে ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ বৈশ্বিক অর্থনীতির ২৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৫.১২ ট্রিলিয়ন ডলারে (বৈশ্বিক রিজার্ভের ৪০ শতাংশ)। রপ্তানি বাণিজ্য ৪.৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং আমদানি বাণিজ্য দাঁড়িয়েছে ২.৯৭ ট্রিলিয়ন ডলার। ফলে একটি শক্তিশালী রিজার্ভ মুদ্রা তৈরির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে এ জোটের।
এছাড়া বিটকয়েনসহ কিপ্টো মুদ্রাগুলোর বৈধতা নিয়ে অনেক দেশে প্রশ্ন থাকলেও ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের সাবেক গভর্নর মার্ক কার্নে বলেন, ‘ভার্চুয়াল মুদ্রা বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে কিং (রাজা) হিসেবে কোনো একদিন ডলারের স্থলাভিষিক্ত হয়ে উঠতে পারে।’