
সবুজে ঘেরা উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা টিলায় বেষ্টিত অনিন্দ্য সুন্দরের সমারোহ চা বাগানে পাতা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ৯০ শতাংশ শ্রমিকই নারী। তাদের দিন শুরু হয় কাকডাকা ভোর থেকে। বিস্তর বাগানে সবুজের হাসি দেখা গেলেও, অদৃশ্য থেকে যায় কেবল শ্রমিকের কান্না এবং আহাজারি।
প্রায় প্রতিটি নারী শ্রমিককেই তাড়াহুড়ো করে গৃহস্থালির কাজ শেষ করে ছোট ছোট সন্তানদের রেখে কিংবা সাথে নিয়ে দলবেঁধে ছুটতে হয় বাগানে। এক চিমটে লবণ-চা খেয়ে সকালের যাত্রা শুরু হয় তাদের। নারী শ্রমিকরা শুধু পাতি (চা পাতা) উত্তোলনের কাজই করেন না, কলম কাঁটা, প্রোনিং বা চারা গাছ রোপণ থেকে শুরু করে গাছের আগাছা পরিষ্কারও করে থাকেন।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে ২৩ কেজি পাতি উত্তোলনের বিনিময়ে মাত্র ১২০ টাকা পেয়ে থাকেন তারা। আর নিয়মিত নারী শ্রমিক সপ্তাহে জনপ্রতি কয়েক কেজি রেশন পান। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে চেহারা হাড্ডিসার দশা চা বাগানগুলোর নারী শ্রমিকদের।
নামীদামী ব্যান্ডের চা খেয়ে আমরা যারা আমাদের প্রাত্যহিক সকালের যাত্রা শুরু করি এবং সেইসাথে সজীবতার নিঃশ্বাস নেই তারা কয়জনই বা জানি এসকল মানুষদের নিষ্পেষিত জীবনব্যবস্থার কথা। কয়জনই বা জানি এই চা উৎপাদন করতে গিয়ে বেশিরভাগ নারী শ্রমিককেই হাড়ভাঙা শ্রম দিতে হয়! চা গাছ ছেঁটে ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি যেমন বাড়তে দেওয়া হয় না তেমনি বাড়তে দেওয়া হয় না লেবার লাইনে চা শ্রমিক নারী এবং তাদের পরিবার বসবাস করার জন্য বরাদ্ধকৃত জায়গা। বাগান কর্তৃপক্ষ থেকে ২২২ বর্গফুটের অর্থাৎ ৮ হাত বাই ১২ হাতের ছাউনিকেও। বাস্তবিক অর্থে যারা চা শ্রমিকের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখেছেন তারাই কেবল বলতে পারবেন চা বাগানে সবুজের ছায়াঘেরা ভাণ্ডারে কতটা অমানবিক ও বর্বর জীবন কাটাতে হয় শ্রমিকদের।
একদিকে নিম্ন মজুরি অন্যদিকে অভাব-অনটনের সংসার, এ দুয়ের যাঁতাকলে মাঝপথে পিষ্ট হচ্ছে নারী চা শ্রমিক ও তাদের সন্তানদের জীবনযাত্রাও।
দেশের প্রতিটি বাগানের শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবি, তাদের নূন্যতম মজুরি যেন ২৫০ থেকে ৩০০ করা হয়। সেটি বাস্তবায়নে তাদের এ সংগ্রাম। কিন্তু সেটি বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না মালিকপক্ষের মধ্যে। একাধিকবার আশ্বাস দিয়েই দায়সারা তারা।
রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-তুফান সবকিছু মাথায় নিয়েই চা বাগানে কাজ করতে হয় নারী শ্রমিকদের। বৃষ্টি বা ঝড়ের সময় সামান্যতম আশ্রয়ের জন্য বাগানগুলোতেই নেই কোনো শ্রমিক ছাউনি। এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এসকল নারী শ্রমিকদের ঝোপঝাড়ই ভরসা, নেই কোনো স্যানিটারি ল্যাট্রিনের ব্যবস্থাও।
প্রতিদিন লাইন চৌকিদার, লেবার লাইনের নম্বরে গিয়ে চিৎকার দিয়ে চা শ্রমিকদের নম্বরের ঠিকানা দিয়ে থাকেন। এরপর নামমাত্র মজুরি! যা তাদের ভাষায় ‘হাজিরা’। জোটে মাত্র ১২০ টাকা। দুপুরের খাবারে নারী শ্রমিকরা পাতি ছানার (চা পাতার ভর্তা) সাথে পেঁয়াজ ও মরিচ দিয়ে রুটি অথবা ভাত খেয়ে থাকেন। এসব খাবার খেয়েই তাদের জীবন চলে। যার ফলে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে বেশিরভাগ নারী চা শ্রমিক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুব বেশি দিন হয়নি চা শ্রমিকের মজুরি ১২০ টাকা হয়েছে। ২০০৭ সালে মজুরি ছিল ৩২ টাকা, ২০০৯ সালে ১৬ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ৪৮ টাকা এবং ২০১৩ সালে করা হয় ৬৯ টাকা। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আগের চুক্তির মেয়াদ পার হওয়ার পর ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর শ্রীমঙ্গলে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়। এতে চা শ্রমিকদের মজুরি ১০২ টাকা থেকে ১২০ টাকায় উন্নীত করা হয়।
এদিকে বাগানগুলোতে নেই পর্যাপ্ত স্কুল। শ্রমিকদের নেই বাড়তি আয়। এজন্য অনেক মা-বাবা ইচ্ছে করলেও তার সন্তানদের স্কুলে দিতে পারছেন না টাকার অভাবে। মর্যাদাপূর্ণ জীবন দূরে থাক, নূন্যতম মৌলিক মানবিক অধিকার থেকেও তারা অনেকে বঞ্চিত। বংশ পরম্পরায় যুগের পর যুগ বাগানে অবস্থান করেও নেই তাদের ভূমির অধিকার। এ যেন নিজ দেশে পরবাসীর মতো জীবন।
সরজমিন দেখা যায়, চা বাগানগুলোতেও নারী শ্রমিক বা তাদের পরিবারের জন্য থাকে না পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা। সেখানে প্রায় শ্রমিককেই রক্তশূন্যতা, স্বাস্থ্যহীনতা, জন্ডিস, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে দেখা যায়। সাধারণ রোগশোকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা এখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। শিক্ষা, বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানীয় জল, স্যানিটারি ল্যাট্রিন, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা, বসবাসের জন্য উপযোগী বাসস্থানসহ স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব বাগান কর্তৃপক্ষের। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে শ্রম আইনে উল্লেখ করা এসবের কোনো কার্যকারিতা প্রায় নেই বললেই চলে।
একাধিক নারী চা শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েও চলে নয় ছয়। নারী শ্রমিক সন্তান প্রসবকালীন সময় মাত্র ২ থেকে সর্বোচ্চ
৩ মাস ছুটি পেয়ে থাকেন। দেশে অন্যন্য পেশায় নিয়োজিত নারীদের মতো ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির দাবি করেন তারা।
মধ্যযুগের ভূমিদাশের মতোই চা মালিকের বাগানের সাথে বাঁধা এই সকল সহজ-সরল শ্রমিকের জীবনকাঠামো। শ্রমিকের দুঃখ দুর্দশার অন্তহীন চিত্র সহজেই অনুমান করা যায় তাদের জীবনযাত্রার দিকে তাকালেই।