
ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই ভারতের আনেক ছাত্র-ছাত্রী ইউক্রেনে ফিরে গেছেন ডাক্তারি পড়া শেষ করতে।
তাদের একজন ২৫ বছর বয়সী ঋষি দ্বিভেদী যে ইতিমধ্যেই সেখানে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন হামলার আগেই সাইরেন বাজিয় সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে আমাদের। দিনে অন্তত চারবার এ রকমভাবে সাইরেন বাজাচ্ছে।’
মেডিক্যালে পঞ্চম বর্ষের ওই ছাত্র উত্তরপ্রদেশের কনৌজ শহরের আদি বাসিন্দা। ইউক্রেনের লাভিভ জাতীয় চিকিৎসাবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন এবং সার্জারিতে স্নাতক কোর্স করছেন তিনি। তার মতো আরো কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে উদ্ধার করে আনা হয়েছিল রাশিয়া হামলা করার শুরুতেই। কিন্তু তিনি গত অক্টোবরে কোর্স শেষ করার জন্য ফিরে গেছেন।
যুদ্ধের শুরুতেই ২২ বছর বয়সী এক মেডিক্যাল ছাত্র গোলার আঘাতে মারা যাওয়ার পর ১৮ হাজার ছাত্র-ছাত্রীসহ মোট ২৩ হাজার ভারতীয়কে সরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু সরকারের নির্দেশিকা উপেক্ষা করেই ওই ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকে ফিরে গেছেন ইউক্রেনে। তারা বলছেন, ডাক্তার হিসেবে কাজ করতে গেলে তাদের সামনে এ ছাড়া আর বিশেষ রাস্তা নেই।
দ্বিভেদীর মতো এগারো শ ছাত্র ইউক্রেনে বসবাস করছেন এখন। বেশির ভাগই লাভিভ, উজগোরোদ আর তেরনোপিলের মতো পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরগুলোতে রয়েছেন। ওই অঞ্চলে রাশিয়ান বিমান হামলা হতে পারে, কিন্তু শহরগুলো থেকে পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গন অনেক দূরে।
তবে শুধু যে ভারতীয়রাই ইউক্রেনে ফিরে গেছেন তা নয়। বিবিসি দেখা পেয়েছে কিছু আফ্রিকান ছাত্র-ছাত্রীরও, যারা লাভিভে রয়েছেন। অন্যরাও ভাবছেন যে তারা কী করবেন।
সৃষ্টি মোজেস নামে লাভিভ শহরের চতুর্থ বর্ষের মেডিক্যাল ছাত্রী বলেছেন, ‘আমরা জানি না যে আমাদের কোর্স শেষ করতে পারব কি না? মাথার ওপর দিয়ে যখন হেলিকপ্টার বা বিমান যাতায়াত করে। তখন আমরা ঘুমাতে পারি না। সব সময় চিন্তা হয়, এই বুঝি হামলা শুরু হলো।’ তিনি যেখানে থাকতেন, সেখানে মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ থাকত না। তাই নিয়মিত বিদ্যুৎ থাকে এ রকম একটা উচ্চবিত্ত এলাকায় ফ্ল্যাট নিতে হয়েছে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় দেরাদুন শহরের মূল বাসিন্দা মোজেসকে।
এই পরিস্থিতিতে কেন ছাত্র-ছাত্রীরা ইউক্রেনে ফিরে গেলেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে পড়াশোনা করে এমন বেশির ভাগ মেডিক্যাল ছাত্র-ছাত্রীই স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসতে চান। কিন্তু তার জন্য জাতীয় মেডিক্যাল কমিশনের কাছ থেকে তাদের অনুমতি নিতে হয়। ওই কমিশনই ভারতে মেডিক্যাল শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যখন বাধ্য হয়ে এই ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনা বন্ধ করে চলে এলো, তখন ভারতের শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন যে ‘তাদের চিকিৎসক করে গড়ে তোলার জন্য যা যা দরকার তা করা হবে।’
‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’ ভারতের কলেজগুলোতে এদের ভর্তি করে নিতে অনুরোধ করেছিল। রাজ্য সরকারগুলোও একই আবেদন করেছিল।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অনুরোধও করেছিল যে ‘এককালীন ব্যবস্থা হিসেবে ফিরে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের যেন ভারতের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।’
কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একেবারে বিপরীত সিদ্ধান্ত নেয়। তারা জুলাই মাসে জানিয়ে দেয়, বিদেশের মেডিক্যাল কলেজ থেকে ভারতীয় মেডিক্যাল কলেজে বদলি নিয়ে আসার কোনো নিয়ম নেই। আবার ইউক্রেন থেকে ফিরে আসা অনেক ছাত্র-ছাত্রী ভারতের মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতেও চাননি। ভারতে ভর্তি হওয়ার জন্য একে তো কঠিন প্রতিযোগিতা আছে আর খরচও খুব বেশি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ফলে ফিরতে হলো তাদের। তেরনোপিল জাতীয় মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বৈশালী সেঠিয়া ইউক্রেন থেকে হাঙ্গেরি হয়ে চলে এসেছিলেন গত বছর মার্চ মাসে। তিনি নভেম্বরে ফিরে গেছেন।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি ইউক্রেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। ‘সবাই জিজ্ঞাসা করছে কেন ইউক্রেনে ফিরছি। আমাদের ফিরতেই হতো।’ বলছিলেন তিনি।
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত মাসে জানিয়েছিল, যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ইউক্রেনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত এমন তিন হাজার ৯৬৪ জন ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীকে ইউক্রেনের বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রায় ১৭০ জন ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রী ইউক্রেনের মধ্যেই নিরাপদ জায়গায় সরে গেছে এমন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এটাও ঘোষণা করেছে, যেসব ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রী ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে মেডিক্যাল কোর্স শেষ করেছেন, তারা বিদেশি মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষায় বসতে পারবেন। বিদেশ থেকে মেডিক্যাল পড়ে ভারতে এসে প্র্যাক্টিস শুরু করতে হলে ওই পরীক্ষায় পাস করতে হয়।
সংবাদ সংস্থা বিবিসি যত ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছে, তারা জানিয়েছেন, ইউক্রেনে পুরো কোর্স শেষ করতে যা খরচ হয়, তা ভারতের কোনো বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের খরচের অর্ধেকেরও কম।
ইউক্রেনের লেভিভে ফিরে গেছেন এমন এক ছাত্র শশাঙ্কের বাবা মৃত্যুঞ্জয় কুমার বলছিলেন, ভারতের বেসরকারি কলেজগুলো যেখানে ৭০ লাখ ভারতীয় টাকারও বেশি নেয়, সেখানে ইউক্রেনে লাগে প্রায় ২৫ লাখ টাকার মতো। লেভিভে বসবাসরত ঋষি দ্বিভেদী বলছেন, এখন তাদের দিকে বিশেষ কেউ নজর দিচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘আমরা ফিরে আসার মাসখানেক পরেও আমাদের নিয়ে চর্চা হতো। কিন্তু এখন আর কেউ বিশেষ বিরক্ত করে না।’ কিন্তু তাদের প্রতিটা দিনই ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে কাটে।
দ্বিভেদী বলেন, আমরা আমাদের অভিভাবকদের বলে দিয়েছি- যুদ্ধ যদি আবার বেশি শুরু হয় আর আমাদের পালাতে হয়, তাহলে আমরা নিজেরাই ব্যবস্থা করে নেব। কাছাকাছি সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে নেব।’