ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যা রোগীদের কখনোই সম্পূর্ণ নিরাময় হয় না। কিছু চিকিৎসা দিয়ে আমরা অবশ্যই এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আগের যুগে এই রোগটি শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেই ঘটত। তবে আজকাল এই রোগটি যে কারো মধ্যে ধরা পড়ছে। সুষম খাদ্য গ্রহণ করা গেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
যারা নিয়মিত হাঁটাচলা বা শারীরিক পরিশ্রম করেন না, অলস বা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন, তাদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
মানবদেহ নিজ ক্ষমতা বলে রক্তে গ্লুকোজ এবং সেল বা কোষ কর্তৃক গ্লুকোজ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনমতো ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে। ইনসুলিনের কাজ হলো রক্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্লুকোজ রেখে বাড়তি সব গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেনে রূপান্তরের মাধ্যমে লিভার ও বিভিন্ন মাংসপেশিতে মজুত রাখা। না খাওয়ার কারণে, উপোস করলে বা বেশি পরিশ্রমের জন্য রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে গেলে গ্লাইকোজেন আবার গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়ে রক্তে জমা হয় এবং পরের সেলে প্রবেশ করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাদের বাবা-মা, ভাই-বোন বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের এই রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে।
এছাড়া যারা নিয়মিত হাঁটাচলা বা শারীরিক পরিশ্রম করেন না, অলস বা অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন, তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
এছাড়া নারীদের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস রোগ হতে পারে। যাদের হৃদরোগ রয়েছে, রক্তে কোলেস্টেরল বেশি, উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তাদেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
যেসব শিশুর ওজন বেশি, যাদের বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস রয়েছে, যাদের মায়ের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হয়েছিল, সেই সব শিশুর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
যেসব লক্ষণ দেখলে ডায়াবেটিস পরীক্ষা জরুরি
১. ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া ও পিপাসা লাগা
২. দুর্বল লাগা ও ঘোর ঘোর ভাব আসা
৩. ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া
৪. সময়মতো খাওয়া-দাওয়া না হলে রক্তের শর্করা কমে হাইপো হওয়া
৫. মিষ্টি জাতীয় জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাওয়া
৬. কোনো কারণ ছাড়াই অনেক ওজন কমে যাওয়া
৭. শরীরে ক্ষত বা কাটাছেঁড়া হলেও দীর্ঘদিনেও সেটা না সারা
৮. চামড়ায় শুষ্ক, খসখসে ও চুলকানি ভাব
৯. বিরক্তি ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠা
১০. চোখে কম দেখতে শুরু করা
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)-এর একটি জরিপে দেখা গেছে, দেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ। এদের মধ্যে ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২৬ লাখ আর ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা ৮৪ লাখ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস অশনাক্ত থাকলে বা চিকিৎসা না হলে কিডনি, লিভার, চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই সঙ্গে শরীরের ত্বক নষ্ট হয়ে যায়, চুল পড়ে যায়। শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও ক্ষতির শিকার হতে পারে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে যা খাবেন
গবেষণায় দেখা গেছে, সবুজ শাকসবজি খেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। তাই বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি খাওয়ার পরামর্শ দেন। যেমন- পালংশাক, পাতাকপি, শালগম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লেটুসপাতা ইত্যাদিতে ক্যালরি এবং কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ খুবই কম থাকে। আসুন জেনে নিই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কি খাবেন-
পালংশাক ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সবচেয়ে সুপরিচিত খাবার।
* পালংশাক: ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য পালংশাক খুব উপকারী। এতে আছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। অল্প সেদ্ধ করে খেলে এর থেকে বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায়। পালংশাক ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সবচেয়ে সুপরিচিত খাবার।
* গাজর: গাজরে ক্যালরি এবং সুগারের উপাদান খুবই কম। গাজরে থাকা পটাশিয়াম কোলেস্টরেল এবং ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গাজর চর্বি কমাতে সাহায্য করে বলে ওজনও কমে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস প্রতিরোধে যেসব ভিটামিন এবং খনিজের প্রয়োজন তাও বিদ্যমান গাজরে।
* টমেটো: চমৎকারভাবে দেহের ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখে এই টমেটো। টমেটোতে খুব কম পরিমাণে শর্করা থাকে। কিন্তু ক্রোমিয়ামের ভালো উৎস টমেটো, যা রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
ব্রকলি হৃদরোগের বিরুদ্ধেও বেশ কার্যকর।
* ব্রকলি: ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অতিব জরুরি একটি সবজি হলো ব্রকলি। ব্রকলি ডায়াবেটিসের সঙ্গে যুদ্ধ করে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। ব্রকলি হৃদরোগের বিরুদ্ধেও বেশ কার্যকর।
* করলা: করলা ইনসুলিন রেজিস্টেন্স কমিয়ে রক্ত থেকে শরীরের কোষগুলোর সুগার গ্রহণ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। তা ছাড়া করলা শরীরের কোষের ভেতর গ্লুকোজের বিপাক ক্রিয়াও বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের সুগার কমে যায়। ডায়াবেটিসের রোগীরা রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত করলা খেতে পারেন।
* বাঁধাকপি: শীতকালীন সবজি পাতাকপি বা বাঁধাকপি। পাতাকপিতে অনেক কম শর্করা রয়েছে। এই সবজিটি টাইপ-২ রোগীদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করে এবং টাইপ-১ রোগীদের রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
* ঢেঁড়স: ঢেঁড়সের মধ্যে থাকা উপকারী ফাইবার দেহের গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে রাখে। তাই ডায়াবেটিস কমাতে ঢেঁড়স অত্যন্ত উপকারী একটি সবজি। ডায়াবেটিক রোগীদের প্রতিদিন খাবারের তালিকায় ঢেঁড়স রাখা উচিত।
* মটরশুঁটি: ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার ডায়াবেটিস রোগীর জন্য অনেক উপকারী। মটরশুঁটি ফাইবারে ভরপুর একটি সবজি। মটরশুঁটি রক্তের গ্লুকোজের মাত্রাকে সাধারণ মাত্রায় রাখে।
* ক্যাপসিকাম: ক্যাপসিকামের রয়েছে নানা উপকারিতা। আপনার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় একটি করে ক্যাপসিকাম রাখলে অনেক রকম অসুখ থেকে মুক্তি পেতে পারেন। এই সবজিটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতেও কার্যকর এবং রক্তে শর্করার মাত্রাও স্থির রাখে। তা ছাড়া ক্যাপসিকামের অ্যাক্টিভেটিং থার্মোজেনেসিস এবং হজম শক্তি উন্নত করার ক্ষমতা রয়েছে, যা দ্রুত ওজন কমাতেও সহায়ক।
* সবুজ চা: সবুজ চা মানুষের শরীরে ইনসুলিনের মতো কাজ করে; ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে এটি।
টক দই একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য। এতে চিনির পরিমাণ খুব কম। এটি রক্তে চিনির পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে।
* ওয়াইল্ড স্যামন: ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য অন্যতম একটি ঔষধি খাদ্য ওয়াইল্ড স্যামন। এতে উচ্চ মাত্রায় ওমেগা-৩ রয়েছে। ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি বড় উৎস এটি। ডায়াবেটিস রোগের পাশাপাশি কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকিও কমায় ওয়াইল্ড স্যামন।
* মাছ: গবেষণায় দেখা যায়, মাছের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ইনসুলিনের সংবেদনশীলতাকে উন্নত করতে সাহায্য করে। এটি গ্লুকোজের ঘনত্ব কমিয়ে ডায়াবেটিস রোগের ঝুঁকি হ্রাসে সহায়তা করে। এতে চর্বিহীন প্রোটিন রয়েছে।
* টক দই: টক দই একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য। এতে চিনির পরিমাণ খুব কম। এটি রক্তে চিনির পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। দুপুরের খাবারের সঙ্গে বা বিকেলের নাস্তায় স্যান্ডউইচের সঙ্গে টক দই খাওয়া যায়। এটি ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে।
* ডিমের সাদা অংশ: ডিম পেশি গঠনকারী খাদ্য। এতে উচ্চমানের প্রোটিন রয়েছে। ডিমের সাদা অংশে উচ্চ মানের চর্বিহীন প্রোটিন এবং কম মাত্রায় কার্বোহাইড্রেট রয়েছে যা ২ ধরনের ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে।
* লেবু: লেবু ও লেবু জাতীয় ফল ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, শরীরে ভিটামিন সির অভাবে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি রয়েছে। তবে লেবু জাতীয় ফল খেলে ভিটামিন সির অভাব পূরণ হয়। জাম্বুরা, কমলা, লেবু এবং লাইমস ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিনের মতো কাজ করে।
* বাদাম: গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি প্রায় ২১ শতাংশ পর্যন্ত কমায় চীনাবাদাম। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ১ আউন্স আখরোট বা কাজুবাদাম ডায়াবেটিস প্রতিরোধে বিস্ময়করভাবে কাজ করে। নিয়মিত বাদাম খেলে হৃদরোগের ঝুঁকিও কমে।